স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক চ্যানেল নিউজ :: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় প্রবল ঝুঁকিতে পড়ছেন অন্তঃসত্ত্বা নারীরা। উচ্চ তাপপ্রবাহের ফলে অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা গর্ভজাত শিশুর জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, অন্তঃসত্ত্বাদের ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা থাকে। এর চেয়ে বেশি তাপপ্রবাহ হলেই ঝুঁকি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে পরিবেশের তাপমাত্রা অন্তঃসত্ত্বার শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে বেশি বা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে পৌঁছলে রক্তপ্রবাহ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তে পারে। এতে গর্ভের শিশুর পুষ্টি ও অক্সিজেনে ঘাটতি তৈরি হতে পারে।
অন্যদিকে গর্ভধারণের পর ১২ সপ্তাহের মধ্যে মায়ের শরীরের তাপমাত্রা ৩৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে শিশুর জন্মগত ত্রুটির ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া অতিরিক্ত তাপে পানিশূন্যতা কিংবা হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হলে অকাল প্রসবের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালের গাইনি ও অবসের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সামছাদ জাহান শেলী বলেন, ‘উচ্চ তাপমাত্রা অন্তঃসত্ত্বার শরীরের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি হলে রক্তের ভারসাম্যহীন প্রবাহ গর্ভের শিশুর পুষ্টি ও অক্সিজেনে ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। পানিশূন্যতা (ডিহাইড্রেশন), হরমোন পরিবর্তনের (প্রোস্টাগ্ল্যান্ডিন ও অক্সিটোসিন) ভারসাম্যহীনতা অকালে প্রসবের সম্ভাব্য সূত্রপাত ঘটায়।
উচ্চ তাপমাত্রার কারণে অন্তঃসত্ত্বারা ঠিকমতো বিশ্রাম নিতে পারেন না। এতে উচ্চ রক্তচাপ বাড়লে খিঁচুনি দেখা দেয়। সেইসঙ্গে ইনফেকশন, পানিশূন্যতা ইত্যাদি সমস্যাও দেখা দেয়। ফলে গর্ভাবস্থায় সন্তানের মৃত্যু হয়। আবার কখনো কখনো পানি ভেঙে গর্ভে প্রিম্যাচিউর শিশুর জন্ম হয়।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ তাপপ্রবাহে অন্তঃসত্ত্বা ও তার গর্ভের সন্তানকে সুস্থ রাখতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। পানিশূন্যতা রোধ করতে পরিমিত স্বাভাবিক পানি পান করতে হবে। ঠান্ডা পানি পান করা যাবে না।’
২০২০ সালে ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত একটি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রার সংস্পর্শে থাকা নারীদের অকাল প্রসব এবং মৃত সন্তান প্রসব হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাপমাত্রায় প্রতি ডিগ্রি বৃদ্ধির জন্য অকাল প্রসবের আশঙ্কা বাড়ে ৫ শতাংশ, উচ্চ তাপপ্রবাহের সময় এ ঝুঁকি বাড়ে ১৬ শতাংশ।
কক্সবাজারের চকরিয়ায় অন্তঃসত্ত্বাদের ওপর আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা যায়, উচ্চ তাপপ্রবাহের কারণে ওই এলাকায় গর্ভপাতের হার বেশি। এ ছাড়া খাবার পানিতে লবণাক্ততার কারণে অন্তঃসত্ত্বাদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বৃদ্ধি পায় এবং গর্ভপাতের সংখ্যাও বাড়ে।
‘দ্য রিস্ক অব মিসক্যারেজ ইজ অ্যাসোসিয়েটেড উইথ অ্যামবিনেট টেম্পারেচার: এভিডেন্স ফর্ম কোস্টাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় চকরিয়া উপজেলার ১৩ হাজার ৩৭৬ বিবাহিত নারীর ১০ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ওই নারীরা সর্বমোট ২৩ হাজার ৪৮২ বার গর্ভধারণ করেন। এর মধ্যে ২ হাজার ৪২২টি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটেছে, যা মোট গর্ভধারণের ১১ শতাংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গর্ভবতী হওয়ার পর ৮ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভপাত হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই গবেষণায় দেখা গেছে, তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অকাল প্রসব এবং মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বেড়েছে। পরিবেশের তাপমাত্রা যখন ১৬ থেকে ২১ ডিগ্রি থাকে তার তুলনায় ২৮ থেকে ৩২ ডিগ্রি থাকলে গর্ভপাতের ঝুঁকি ২৫ শতাংশ বেশি হয়।
গবেষণার যুক্ত আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী মনজুর আহমেদ হানিফী বলেন, ‘চকরিয়া এলাকায় গ্রীষ্মকালে গর্ভপাতের হার ১২ শতাংশ। শীতকালে ১০.২ শতাংশ। আর শরৎকালে ৯.৪ শতাংশ। সমুদ্র থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে বসবাসকারী নারীদের গর্ভপাতের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে ২০ বছরের নিচে এবং ৩৫ বছরের ওপরের নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। অন্যদিকে গর্ভধারণের সংখ্যা বেশি হলেও গর্ভপাতের ঝুঁকি বাড়ে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার বছর ধরে কক্সবাজারের চকরিয়া এলাকায় মার্চ মাস থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ হচ্ছে। গত বছরের ২৮ এপ্রিল তীব্র গরমে বরইতলী ইউনিয়নের বানিয়ারছড়া গ্রামের আছিয়ার গর্ভপাত হয়। তিনি বলেন, ‘এত গরম আগে কখনো পড়েনি। তারপর আবার লোডশেডিং। গরমে অস্থির হয়ে পড়তাম। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতো। পেট শক্ত হয়ে যেত। ওইদিন প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। ঘরে টিকতে পারছিলাম না। রাতে বাথরুমে যাওয়ার পরই পানি ভাঙা শুরু হয়, এর সঙ্গে ব্লিডিং। ২০ মিনিটের মধ্যে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বলেন, প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে সাড়ে তিন মাসের গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে গেছে।’
তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এ বছরের ৭ এপ্রিল গর্ভপাত হয়েছে বিএম চর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের ২০ বছর বয়সী রেহানার। তিনি জানান, রেহেনার (আসল নাম নয়, ২০) মতে, ‘রোদের তাপ যত বাড়তে থাকে ঘরে টেকা দায় হয়ে পড়ে। অতিরিক্ত গরমে অস্থির লাগত। প্রচণ্ড মাথাব্যথা করত। ২৬ মার্চ ব্লিডিং শুরু হয়। সঙ্গে সঙ্গে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে যাই। সেখানকার ডাক্তার বলেন, বাচ্চা ঠিক আছে। আমাকে ওষুধ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ব্লিডিং বন্ধ হয় না। সঙ্গে পেটে ও কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ১১ দিন ওষুধ খেয়েও কোনো উন্নতি না হওয়ায় শেষমেষ চকরিয়া সরকারি হাসপাতালে যাই। তখন ডাক্তাররা জানান, বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে।’
শুধু কক্সবাজার নয়, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বেড়েছে তাপমাত্রা। সেইসঙ্গে ঝুঁকির মুখে পড়ছেন অন্তঃসত্ত্বারা। ঢাকায় গত ২৮ এপ্রিল তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ৬ মে ছিল ৩২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ সময়টায় উচ্চ তাপপ্রবাহের কারণে ঢাকা শহরে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেকেরই গর্ভপাত হয়েছে।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। ১ এপ্রিল থেকে ১৫ মে সময়ের মধ্যে তাদের কারও গর্ভপাত হয়েছে, কেউবা মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। তাদের মধ্যে একজন কল্যাণপুরের মলি। ৩৫ সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। গর্ভে সন্তান আসার পর অতিরিক্ত গরমে তার রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না। হঠাৎ করে এক দিন পানি ভাঙা শুরু হয়। এ কারণে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের গাইনি বিভাগে ভর্তি হন। সেখানে চিকিৎসক জানান, পানিশূন্যতার কারণে গর্ভেই সন্তান মারা গেছে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে মলি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে অতিরিক্ত গরমের কারণে শরীর অস্থির লাগত। প্রচণ্ড পানি পিপাসা পেত। পেট শক্ত হয়ে যেত। বুঝতেই পারিনি আমার সন্তান ভালো নেই।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার বস্তি এলাকায় অন্তঃসত্ত্বারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকেন। প্রচণ্ড গরমের সময় অন্তঃসত্ত্বারা কাজ করলে বা বাতাসহীন বন্ধ জায়গায় থাকলে, মৃত সন্তান প্রসব ও গর্ভপাতের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়ে যায়।
অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় জ্বলীয় বাষ্প, লবণাক্ততা ও তাপমাত্রা বেশি হওয়ায় অন্তঃসত্ত্বাদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়, যা গর্ভের সন্তানের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এমসিএইচ ইউনিটের প্রকল্প ব্যবস্থাপক (কৈশোরকালীন এবং প্রজনন স্বাস্থ্য) ডা. মনজুর হোসেন বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বার পূর্ণ বিশ্রাম দরকার। দিনের বেলা দুই ঘণ্টা এবং রাতে পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু তাপপ্রবাহ বৃদ্ধির কারণে এবং বিদ্যুৎ না থাকলে অন্তঃসত্ত্বারা বিশ্রাম নিতে পারেন না। এতে তারা মানসিক দুশ্চিন্তায় থাকেন। হতাশাগ্রস্ত থাকেন। এর প্রভাবে কম ওজনের সন্তান জন্ম হতে পারে। ৩৭ থেকে ৪২ সপ্তাহের মধ্যে সন্তান জন্ম না হয়ে প্রিম্যাচিউর ডেলিভারিও হতে পারে। মায়ের মানসিক দুশ্চিন্তা গর্ভের সন্তানের ওপর প্রভাব ফেলে। তাপমাত্রা ও জ্বলীয় বাষ্প বাড়লে প্রজনন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, কম ওজনের শিশু, প্রিম্যাচিউর শিশু জন্মের ঝুঁকি বেড়ে যায়।’